স্বদেশ ডেস্ক:
বোরো সংগ্রহ অভিযান শেষ হতেই জানা গেল, সরকারের গুদামেই নষ্ট হচ্ছে ৮ হাজার কোটি টাকার আমন চাল। বছরখানেক ধরে বিভিন্ন সিএসডি-এলএসডিতে এ চাল পড়ে রয়েছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর সারাদেশের খাদ্য বিভাগ থেকে আসা মজুদ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানতে পেরেছে। ২ লাখ ৬ হাজার ২৭৪ টন এ চালের (প্রতিকেজি ৪০ টাকা) মূল্য ৮ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। তবে চালের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সরকার যখন বিব্রত, তখন বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন এ চাল ব্যবহার করা হয়নি, সে প্রশ্ন এখন ঘুরেফিরে আসছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের মতে, বোরো ১০ এবং আমন চালের বয়স ১২ মাস পার হলে এর গুণগতমান হ্রাস পেতে থাকে। অধিদপ্তরের হিসেবেই পুরনো চাল এ বছরের মধ্যে শেষ করতে না পারলে গুণগতমান হারাবে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় দেশে উৎপাদিত চাল কতদিন গুদামে মজুদ রাখা যায়? এমন প্রশ্নে খাদ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তারা জানান, দানাদার খাদ্য বিশেষ করে চালের মান রক্ষার কতগুলো উপায় আছে। এগুলো প্রতিপালন করলে দেশে যে প্রক্রিয়ায় আমরা চাল সংরক্ষণ করে থাকি, তাতে এক-আধ বছর এ চাল মানুষের খাওয়ার যোগ্য থাকে।
মেয়াদোত্তীর্ণ চালের ক্ষতিকর দিক প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একাধিক সূত্র জানায়, সব খাদ্যপণ্যেরই একটা জীবনকাল থাকে। চালের বয়স বেড়ে গেলে তাতে এক ধরনের ছত্রাক ও পোকা জন্মায়। ফলে আলফাটক্সিন ও মাইক্রোটক্সিনের সৃষ্টি হয়। এটা মানবদেহের জন্য, বিশেষ করে শিশুদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তিনি বলেন, তখন এ ধরনের চাল বড়জোর গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সেটিও উদ্বেগের কারণ। যে গরু ওই চাল খাবে, সে গরুর মাংস খেলে মানুষও মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে।
খাদ্য অধিকার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহিদুর রহমান এ নিয়ে বলেন, চালের দাম যখন আকাশ ছুঁয়েছে, তখনই গুদামের এই বিপুল পরিমাণের চাল খাদ্য নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন খাতে সরবরাহ করে কিছুটা হলেও বাজার স্থিতিশীল রাখা যেত। কিন্তু কেন তা করা হয়নি সেটা বোধগম্য নয়।
বিদ্যমান বাস্তবতা বলছে, এ বছরের শুরুর দিকে চালের বাজার ঊর্ধমুখী হওয়ায় সরকারকে বিব্রত হতে হয়েছে। অথচ এসব চাল অবলীলায় রেখে দেওয়া হয়েছে গুদামে। সরকারের খাদ্য নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির (খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, বিজিডি, ভিজিএফ, ইপি-ওপিসহ নানা খাতে এ চাল বিতরণ হওয়া কথা ছিল। উদ্বেগের বিষয় হলো, হাজার হাজার কোটি টাকার পুরনো চাল নিয়ে বেকায়দায় থাকা খাদ্য অধিদপ্তর এখন চাইছে, মান ঠিক রেখে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিভিন্ন খাতে দ্রুত বিতরণ করতে। খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বিষয়টি অবগত হয়ে আইআরটিসি, ডিআরটিসির মাধ্যমে সূচি জারি করে সুষম বণ্টনের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে। এই চাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন বোরো চাল আটকা থাকবে গুদামে।
সরকারি নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি টাকায় খাদ্যশস্য (চাল-গম) কেনার ৩ মাসের মধ্যেই বিতরণ করতে হবে। নইলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও খাদ্য গুদামের সংরক্ষণ ব্যবস্থার কারণে তা পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যেই গুণগতমান হারাবে। অথচ ৯ মাস গুদামে পড়ে থাকা ২ লক্ষাধিক টন কেন বা কী উদ্দেশ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে এর নেপথ্য কারণ অজানাই থাকছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, নতুন চাল গুদামে ঢোকার সময় তা ‘ডিসডি-৩’ অর্থাৎ খুব ভালো মানের বলে সার্টিফিকেট পেতে পারে। চাল গুদামে মজুদ করার সময়ই বলা হয়ে থাকে যেন পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে ওই চাল ভোগ করার ব্যবস্থা করা হয়। তিন মাস পার হলে একই চাল ‘ডিসডি-২’ গ্রেডে নেমে আসে। এ ক্ষেত্রে বলা হয় পরবর্তী ২ মাসের মধ্যে বিতরণ করতে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সরকারি চাল যত পুরনো ও দুর্গন্ধযুক্তই হোক না কেন, বরাবরই নিজেদের পরীক্ষাগার থেকে তা ‘খুব ভালো’ বলে সনদ পাচ্ছে।